আলিপুর , গড়িয়াহাট বা শ্যামবাজারের কোন সম্ভ্রান্ত বাড়িতে সমবেত হয়েছেন শিক্ষিত ভদ্র মানুষেরা।ঘরে পট , প্রতিকৃতি দেবতার আর দেবতুল্য মানুষদের। ধুপদানিতে ধুপ জ্বলছে , টানা ফরাস পড়েছে ঘর জুড়ে। বড়দের সঙ্গে ছোটরাও এসেছে অনেকে। উত্কণ্ঠা সবার , আসবেন তিনি। গাইবেন গান , পদাবলী কীর্তন। তিনি এলেন। পরনে সাদা সরু পাড় ধুতি , গায়ে সাদা চাদর , চোখে চশমা। সর্বাঙ্গে না কোনো প্রসাধন না কোনো অলঙ্কারের চিহ্ন। মাথা নীচু আর শান্ত পায়ে ঢুকলেন। তারপর টেনে নিলেন হারমোনিয়ামটা। সঙ্গে গুরুভগ্নী , ছাত্রীরা। তারাও প্রস্তুত ছিলোনা মোটে । না , আজ কোনও পদাবলী কীর্তন নয়। আজ শুধু নামগান। যদিও আজ সোমবার , মৌন থাকার দিন। কিন্তু ঈশ্বরের নাম তো সবদিনই নেওয়া যায়! তাই বাধা নেই।
মধুর উদাত্ত স্বর।ঋজু ভঙ্গিতে বসে রইলেন একই ভাবে !চোখের পাতা একবারও খুললেন না। শান্ত ভাবে গেয়ে চলেছেন 'হরে কৃষ্ণ, হরে কৃষ্ণ, কৃষ্ণ কৃষ্ণ, হরে হরে -----' সুর চলেছে সরল গতিতে। শান্ত সমাহিত গায়িকার প্রাণের আবেগ সংক্রমিত হচ্ছে শ্রোতাদের মধ্যে ধীরে ধীরে।মেয়ের গানের এই আবেগ বোধহয় অভিভূত করেছিল যতীন দাস রোডের নলিনীমোহন বন্দ্যোপাধ্যায়কে। ছবিকে তাই ভর্তি করে দিয়েছিলেন বাসন্তী বিদ্যাবিথীতে আর সঙ্গীত ভারতীতে।
নলিনীমোহন ছিলেন ব্যবসায়ী মানুষ। প্রভাব প্রতিপত্তি আর নামডাক ছিলো তখনকার কলকাতায়।তবে বেশী টান ছিলো দেশের কাজে। তবু এতো কিছুর মধ্যেও মেয়ের জীবনদর্শনের প্রতি তাঁর খেয়াল ছিলো সবসময়। মায়ের ছিল অদ্ভুত সুকণ্ঠ। তাই প্রথাগত সঙ্গীত শিক্ষার আগেই মা পুষিয়ে দিয়েছিলেন প্রাথমিক গানের শিক্ষা। বাকিটুকু স্বদেশি আন্দোলনের যুগে পথে পথে গেয়ে যাওয়া গান শুনে। সেইসব সুর অনায়াসেই তুলে নিতেন কণ্ঠে। তার প্রমাণ মিলেছিল এ্যালবার্ট হলে ছোট্ট মেয়েটি যখন গাইল ---
বন্দে মাতরম-
নলিনীমোহন ছিলেন ব্যবসায়ী মানুষ। প্রভাব প্রতিপত্তি আর নামডাক ছিলো তখনকার কলকাতায়।তবে বেশী টান ছিলো দেশের কাজে। তবু এতো কিছুর মধ্যেও মেয়ের জীবনদর্শনের প্রতি তাঁর খেয়াল ছিলো সবসময়। মায়ের ছিল অদ্ভুত সুকণ্ঠ। তাই প্রথাগত সঙ্গীত শিক্ষার আগেই মা পুষিয়ে দিয়েছিলেন প্রাথমিক গানের শিক্ষা। বাকিটুকু স্বদেশি আন্দোলনের যুগে পথে পথে গেয়ে যাওয়া গান শুনে। সেইসব সুর অনায়াসেই তুলে নিতেন কণ্ঠে। তার প্রমাণ মিলেছিল এ্যালবার্ট হলে ছোট্ট মেয়েটি যখন গাইল ---
বন্দে মাতরম-
সুজলাং সুফলাং মলয়জ শীতলাম-
সভায় এসেছেন সরোজিনী নাইডু , আর বিশিষ্ট নেতারা। মিষ্টি রিণরিণে সুর ভেসে আসছিল বুকের মাঝখান থেকে।ছোট্ট শরীরটা যেন হাওয়ায় ভাসছিল। ধীরে ধীরে অনেক উঁচুতে উঠে যাচ্ছে সে। মেয়ের গান শুনে নলিনীমোহনের বুক গর্বে ভরে যাচ্ছিল।এ মেয়ের সঙ্গীত সাধনা থামিয়ে রাখা যায়না। গান শেখালেন নবদ্বীপ ব্রজবাসী আর রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের কাছে।
১৯৪১ সালে স্বদেশী রেকর্ড কোম্পানি ভারত রেকর্ড থেকে ছবির প্রথম রেকর্ডে প্রকাশ পেল নীহারবিন্দু সেনের কথা ও সুরে দুটি ভজন " প্রভু তোমারি রূপের মাধুরী .. আর " মম অন্তর-মন্দিরে। সিদ্ধেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গীত পরিচালনায় ১৯৪৮ সালের 'সর্বহারা' ছায়াছবিতে প্লেব্যাক করলেন।
সারাটি জীবন তিনি সঙ্গীতপিয়াসী বাঙালীকে সারাক্ষণ ভক্তিরসে ডুবিয়ে রেখেছিলেন । এইচ.এম.ভি. আর কলম্বিয়া রেকর্ড থেকে সেসব গান প্রকাশিত হয়েছে। নিতাই ঘটকের পরিচালনায় ' কিবা শীতল তব অঙ্গখানি'/'হামারি এক বচন শুনলো' (১৯৫৫) , চিত্ত রায়ের সুরে কাজী নজরুল ইসালামের কথায় 'না মিটিতে মন সাধ' /'সখি গো বৃথা প্রবোধ দিসনে ললিতে ' (১৯৫৬) , বীরেন ভট্টাচার্যর সুরে এবং সরল গুহর কথায় 'নন্দন বন হতে হে প্রভু' /'বাজে ঝন ঝন ঝন'(১৯৫৭), এবং ১৯৬৭ সালে শারদীয় পুজোর গানে রত্নেশ্বর মুখোপাধ্যায়ের সুরে ' তুমি মধু তুমি মধু তুমি মধু' ( কথা- অশ্বিনী কুমার দত্ত) /'বিরহ কাতরা বিরহিণী রাই '( চণ্ডীদাস) আজও শ্রোতার মনের মনিকোঠায় জায়গা নিয়ে আছে।
![]() |
১৯৭৩ সালে এইচ.এম. ভি. থেকে প্রকাশিত একটি পদাবলী কীর্তনের এল. পি. রেকর্ড কভারের অংশ |
গীতশ্রীর জীবনে কীর্তনগান ছিলো সাধনার মূলধন ! তাঁর ভক্তিরস ছিলো মূর্ত প্রসবণের মতো। সেই সুরপ্লাবনে কেবল শান্তির সঞ্জীবনী স্পর্শই পাওয়া যায়। সেখানে কোনও উদ্দামতার অবকাশ নেই। ছিলোনা কোনো গর্জনতর তরঙ্গের সম্ভাবনা । সেখানে শুধু শান্তির গতিময়তা। আত্মনিবেদন আর তন্ময়তা। শুধু কীর্তন নয় ,তাঁর মধুর কণ্ঠের মিষ্টি বাতাবরণে প্রাচীন প্রার্থনাসঙ্গীত, ভক্তিগীতি, লোকসঙ্গীত, কান্তকবির মরমী সুর, অতুলপ্রসাদের গানের সৌন্দর্যানুভুতি আর বৈষ্ণব পদাবলীর সুমধুর ব্যঞ্জনা এক অপরূপ ধ্বনি সৌধ গড়ে তুলেছিল।। তিনি ছিলেন প্রকৃত সাধিকা।ভক্তিরসে পরিপূর্ণ তাঁর কণ্ঠ একসময় বিংশ শতকে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে প্রসারিত হয়েছিল ভাবরস পিপাসু শ্রোতার মনের মন্দিরে। জীবনে খ্যাতি এসেছিল। যশ ,অর্থ সব।কিন্তু সারাজীবন ধরে তাঁর বাস্তব জীবন যাত্রার ধারা বদলে যায়নি। সাদাসিধে এক আড়ম্বরহীন জীবন, এমনকি নিজের কাজটা নিজ হাতে করে নেওয়ার অভ্যেসটুকু নষ্ট হয়নি কোনোদিনও।চারপাশের পরিবর্তনশীল পৃথিবীতে গীতশ্রী ছিলেন স্থির। বিদেশে যাবার সুযোগ এসেছে বার বার। তিনি ফিরিয়ে দিয়েছেন।তাঁর জীবনের অর্ধেক জুড়ে ছিলেন ঠাকুর আর বাকী অর্ধেক ছিল গান। জীবনের সব কিছু যেন সময় দিয়ে বাঁধা ঘড়ির মতো ঘণ্টা-মিনিট আর সেকেণ্ডে। কিন্তু ছবি গান শুরু করলে খেয়াল থাকতো না কখন শেষ করবেন।আকাশবাণীর ফ্লোর ম্যনেজার বিপর্যস্ত হয়ে পড়তেন মাঝে মাঝে গান সমাপ্তির ইঙ্গিত দিতে গিয়ে।সময় দিয়ে ভক্তিকে তিনি কোনদিন আবদ্ধ রাখতে পারেননি।তবুও এই জীবনের সাথে তাঁর কোন দ্বন্দ্ব ছিলোনা । সবকিছুর প্রয়োজনে যেটুকু দরকার সেইটুকুই করেছেন মন প্রাণ দিয়ে, শুধু নিজে জড়িয়ে পড়েননি সংসারে।কিন্তু তার জন্য আক্ষেপ ছিলনা। সবসময়ই বলতেন ' ঠাকুর আছেন , আছেন মা আনন্দময়ী। আর আছে গান। পূর্ণতার জ'ন্য আর কি চাই এই ছোট্ট জীবনে ?'
https://youtu.be/GP9xCz5Y8Zk
Bah....good write up !!👍👍
ReplyDeleteঋদ্ধ হ'লাম...
ReplyDeleteঋদ্ধ হ'লাম...
ReplyDeleteঅপূর্ব অপূর্ব
ReplyDeleteধন্যবাদ 😍
Deleteধন্যবাদ
Delete