"বাড়িটা আমার অনেক দিনের চেনা। প্রায় তিরিশ বছর।নোনা ধরা পুরোনো বাড়ি। তিরিশ বছরে অনেক কিছু বদলে গেছে। বদলায়নি বাড়িটার চেহারা। এই জীর্ণ প্রাসাদে প্রায়ই সুর ভেসে ওঠে।ঠিক তখন মনে হয় বাড়িটা যে ধ্বসে পড়েনি, তার কারণ মনে হয় সুরের গাঁথুনি।যিনি সুরসাধক তাঁর কাঁচা চুল পাকা হয়েছে, দাঁত অন্তর্হিত—কিন্তু সুর অনড়।গান ধরলেই বিবর্ণ দেওয়ালে রামধনুর রঙ।হলুদ পাতায় সবুজ শিরা।" ১৯৮৫ সালে ‘সুকন্যা’ পত্রিকায় লিখেছিলেন মানব গুপ্ত ছদ্মনামে তাঁর এক ছাত্র।
সাধকের নাম অখিলবন্ধু ঘোষ । নামটা শোনার সঙ্গে সঙ্গে যেন হৃদয়াকাশে ভিড় করে আসে এমন সব গান, যে গান শুনতে চেয়েছে মন বার বার - ‘তোমার ভুবনে ফুলের মেলা’ , ‘কেন তুমি বদলে গেছ’ , ‘এমনি দিনে মা যে আমার হারিয়ে গেছে ‘। যেন কোনো এক উদাসীন বাউল গেয়ে চলেছে যুগের পর যুগ ধরে যার সঞ্চরণ এখনোও কান পাতলে শোনা যায় । তাঁর গানের সহজ সরল অনাড়ম্বর সৌন্দর্য্য শ্রোতার মনকে আবিষ্ট করে চিরকাল । সম্পূর্ণ প্রচারবিমুখ এক শিল্পী সারাটি জীবন শুধু গানকেই আঁকড়ে ধরে বেঁচে ছিলেন । কি পাব আর কি পাবনা সে হিসেব করেন নি কোনোদিন। গান ছিল তার চলার পথের আনন্দ । গান ছিলো তাঁর জীবনের সাধনার ধন ।
![]() |
যৌবনে অখিলবন্ধু |
অখিলবন্ধুর জন্ম ২০শে অক্টোবর ১৯২০ । পিতা বামনদাস ঘোষের আদি নিবাস ছিল রানাঘাটের গাঙনাপুরে।মামার বাড়ী নদীয়ার চাকদায় । মায়ের নাম মনিমালা দেবী। মামার বাড়িতেই ছোট থেকেই মানুষ অখিল । মামা কালিদাস গুহ ছিলেন সঙ্গীত অনুরাগী । ছোট থেকেই তাই অখিলবন্ধুর গানের প্রতি ভালোবাসা তৈরী হয় ঐতিহ্যের পথ ধরে । যেকোনো গান শুনে শুনে নিখুঁতভাবে কণ্ঠে তুলে নিতেন ছোট্ট অখিল। ভাগ্নের এমন সংগীতপ্রীতি দেখে মামা কালিদাস গুহ তাঁকে প্রথমে নিজেই গান শেখাতে শুরু করেন। একটা সময় বামনদাস ঘোষ চলে আসেন কলকাতার ভবানীপুরের ২৫ বি, টার্ফ রোডের ভাড়া বাড়িতে। সেখানে অখিলকে পড়াশোনার জন্য ভর্তি করেন ভবানীপুরের নাসিরুদ্দীন মেমোরিয়াল স্কুলে। কিন্তু ম্যাট্রিক পাশ করার পরে আর পড়াশোনা করার চেষ্টা না করে সম্পুর্নভাবে ঢুকে পড়েন গানের জগতে । গানকে করেন চলার পথের পাথেয়। গানের প্রথাগত শিক্ষার জন্য সংগীতগুরু হিসাবে প্রথমে পান নিরাপদ মুখোপাধ্যায়কে । এরপর সংগীতসাধক আচার্য তারাপদ চক্রবর্তীর কাছে নাড়া বেঁধে প্রায় পাঁচ বছর গান শেখেন তিনি। তাছাড়া শাস্ত্রীয় সঙ্গীতের তালিম নেন আচার্য চিন্ময় লাহিড়ীর কাছেও ।
![]() |
সন্তোষ মুখোপাধ্যায় |
সংগীতগুরুগণ ছাড়াও অভিন্নহৃদয় সহধর্মিনী দিপালী দেবী ছিলেন তাঁর গানের একমাত্র সহচরী ও ছায়াসঙ্গিনী । নিঃসন্তান দিপালী দেবী সারাজীবন পাশে থেকেছেন কি গানে, কি বাস্তব জীবনের ঘাত প্রতিকূলতায়। একাকী যে সাধনা , অবলম্বন বিহীন যে অবস্থিতি, সঙ্গতবিহীন যে সঙ্গীত ,তা নিঃসন্তান দিপালী দেবীর সংস্পর্শে সার্থকতা পেয়েছিল অখিলবন্ধুর জীবনে । দিপালী দেবী ছিলেন সুরসিকা। তিনি নিজে যেমন গান গাইতেন, সুরসৃষ্টি ও করতেন । অখিলবন্ধুর গাওয়া ‘যেন কিছু মনে কোরোনা , কেউ যদি কিছু বলে’,’সারাটি জীবন কি যে পেলাম’ গানের সুরকার ছিলেন শ্রীমতী দিপালী ঘোষ।
সঙ্গীত জীবনের প্রথম দিকে বেতারে অখিলবন্ধু খেয়াল ,ঠুংরী ও রাগপ্রধান গাইতেন । ১৯৭৭ সালে মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানি থেকে ১২টি রাগপ্রধান গানের এল.পি. রেকর্ডে প্রকাশিত ‘জাগো জাগো প্রিয়’(ভাটিয়ার), ‘বরষার মেঘ ভেসে যায়’ (সুরদাসী মল্লার), ‘কেমনে জানাবো বলো’(তিলক কামোদ), ‘সে কুহুযামিনী চমকে দামিনী’ ( জয়জয়ন্তী) প্রভৃতি গানগুলো শুনলে বোঝা যায় তিনি বাংলা রাগসঙ্গীতে কত নিপূণ আর গভীর ছিলেন । এই রেকর্ডের প্রতিটি গানের আদ্যপান্ত তরঙ্গের পর তরঙ্গ তুলে শ্রোতার মনকে তৃপ্ত করে।
![]() |
অখিলবন্ধু ঘোষের প্রথম রেকর্ড |
শিল্পীর জীবনের প্রথম রেকর্ড প্রকাশিত হয় ১৯৪৭ সালের জানুয়ারী মাসে মেগাফোন রেকর্ড কোম্পানি থেকে ‘একটি কুসুম যবে ফুটেছিল’ এবং ‘আমার কাননে ফুটেছিল ফুল ’ এই দুটি আধুনিক গানের মাধ্যমে । প্রথম রেকর্ডের প্রথম গানের গীতিকার ছিলেন তিনি নিজেই। আর উল্টোপিঠের গানের গীতিকার ব্যোমকেশ লাহিড়ী। গানের সুরকার সন্তোষ মুখোপাধ্যায়। শুধু তাই নয় তার দ্বিতীয় রেকর্ডেরও (এইচ ১৩০১) একটি গানে গীতিকাররূপে অখিলবন্ধুকে পাওয়া যায় । দ্বিতীয় রেকর্ড প্রকাশিত হয় ১৯৪৮ ফেব্রুয়ারী মাসে হিন্দুস্থান রেকর্ড কোম্পানি থেকে দিলীপ সরকারের কথা ও সুরে ‘নতুন জীবন দেখাও আমারে’ , এবং তাঁর নিজের কথা ও সুরে ‘ফাগুনের চাঁদ ডুবে গেল ‘ দুটি গানে । হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে তাঁর পরপর চারটি রেকর্ড( এইচ. ১৩০১, এইচ. ১৪০৪, এইচ. ১৪৪০,এইচ. ১৪৮৮), জনপ্রিয়তা পাওয়ার পর গ্রামোফোন কোম্পানী থেকে তিনি আমন্ত্রন পান এবং এইচ. এম. ভি. থেকে তার প্রথম রেকর্ডটি প্রকাশ পায় ১৯৫৩ সালে গৌরীপ্রসন্ন মজুমদারের কথায় ও দিলীপ সরকারের সুরে ‘কেন প্রহর না যেতে –‘ ও ‘ মায়ামৃগ সম’ (এন. ৮২৫৪৭) এই দুটি আধুনিক গান দিয়ে । এরপর ‘ পিয়াল শাখার ফাঁকে ওঠে’, এবং ‘শিপ্রা নদীর তীরে ( ১৯৫৪, মার্চ )। মোট দুটি রেকর্ডের চারটি কালোত্তীর্ণ গান এইচ.এম.ভি. তে তাঁর জনপ্রিয়তা উত্তরোত্তর বৃদ্ধি করে , অথচ এমন একটা স্বনামধন্য আর বিশ্বখ্যাত কোম্পানিতে তিনি কেন মাত্র দুটো রেকর্ড করে ফিরে আসেন তার কারণ জানা যায়নি। অনুমান করা যায় হয়তো তাঁর খোলা মেজাজ এবং সরল, আত্মভোলা , আবেগপ্রবণ স্বভাবের জন্য । নিজের লাভ লোকসান বিস্মৃত হয়ে থেকেছেন চিরকালই । ১৯৫৮ সালে মেগাফোন কোম্পানীর প্রতিষ্ঠাতা ও কর্ণধার জিতেন্দ্রনাথ ঘোষ প্রয়াত হন এবং কোম্পানি তারপর কিছুদিন মন্দার মধ্যে চলে। সে সময় কমল ঘোষের আহ্বানে কোম্পানির দুর্দিনে আবার ফিরে আসেন অখিলবন্ধু এবং একের পর এক কালজয়ী গানের উপহার দেন, যা মেগাফোনকে বানিজ্যিক সাফল্য এনে দেয়।১৯৫৯ সালে এই কোম্পানিতে রেকর্ড করেন দুটি আধুনিক গান তাঁর নিজের সুরে। গান দুটি ছিলো ‘কবে আছি কবে নেই’ (কথা-পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়) এবং ‘ ওই যে আকাশের গায়’ (কথা- শান্তি ভট্টাচার্য) ।
![]() |
হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে প্রকাশিত শিল্পীর প্রথম রেকর্ড |
ছায়াছবির গানে তেমন করে তাঁকে আমরা পাইনি। সিনেমা জগৎ সম্বন্ধে তাঁর মনে সর্বদা একটা দ্বিধা আর অনিহা কাজ করতো। ভাবতেন ছায়াছবির জগৎ ‘অন্ধকার জগৎ’। যদিও বিভিন্ন মহলে তিনি উল্লেখ করেছেন ‘শ্রী তুলসীদাস’(১৯৫০) ছবিতে তিনি প্রথম প্লেব্যাক করেন , তবে সেই গানের জন্য প্রকাশিত রেকর্ডের সন্ধান পাওয়া যায়নি । তাই ১৯৫২ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত ‘মেঘমুক্তি’ ছায়াছবিতে একটি সমবেত গানকে তাঁর প্রথম রেকর্ডে প্রকাশিত গান ব’লে ধরে নেওয়া যায়। ‘মেঘমুক্তি’ র গানটি ছিল ‘মাদল বাজা ওরে বাজা বাঁশি’(এইচ.১৪৮২ জি) । গানের কথা লিখেছিলেন তড়িৎকুমার ঘোষ এবং সুরকার উমাপতি শীল। এই গানে সহশিল্পীরা ছিলেন উৎপলা সেন এবং বাণী সেনগুপ্ত।
শিল্পী নিজের বহু গানে সুরারোপ করলেও অন্যান্য শিল্পীদের গানে
তাঁর সুরসৃষ্টি খুবই সীমিত। ১৯৭৪ সালে সন্ধ্যা
মুখোপাধ্যায়ের কণ্ঠে ‘মনে
নেই মন’ /’যমুনা কিনারে’ ( ৪৫ জি.ই. ২৫৪৯০)
(গীতিকার –পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়) এবং ১৯৮৫ সালে কবীর দাসের লেখা একটি ভজন ‘গুরু মোহে দে
গ্যয়ে ’ গানে তিনি সুরারোপ
করেন । এছাড়া বেশ কয়েকজন বিস্মৃতপ্রায় শিল্পীর
গানে তিনি সুর দিয়েছিলেন
যে গানগুলি এই জন্মশতবর্ষে স্মরণ করা যায়, যেমন - ‘আধেক ফাগুনে’/রাতের শিশিরের’ (১৯৪৮),
শিল্পী –অতুল মুখোপাধ্যায়, গীতিকার- তড়িৎকুমার ঘোষ ; ‘তোমার
ভুবনে’/’আমার আঙিনা তলে’ (১৯৪৯),
শিল্পী-শ্যামল দাশগুপ্ত, গীতিকার- শরদিন্দু ভট্টাচার্য
; ‘যমুনা কেন উঠে ছলকি’ ( ১৯৫০), শিল্পী-গীতশ্রী আরতি সরকার, গীতিকার- কানাই
ঘোষাল ।
![]() |
First Playback released on Record |
এইচ.এম. ভি. মেগাফোন ও হিন্দুস্থান রেকর্ড
ছাড়াও ১৯৫৮
সালে আরো দুটি রেকর্ড করেন ‘NEOTUNE’
কোম্পানি থেকে ‘ আর তো চলেনা রাধা’ এবং
‘গোকুল ছাড়িয়া কালা’ এবং কলম্বিয়া থেকে প্রকাশিত একমাত্র
রেকর্ডের গান ‘ও রাই কি বেয়াধি হইলো’ এবং ’ওগো রাই কমলিনী ‘। এছাড়া শিল্পী দুটি রবীন্দ্রসঙ্গীত রেকর্ড করেন যার একটি
‘কার মিলন চাও বিরহী’ যা তাঁর মৃত্যুর পর সিডিতে
প্রকাশিত। অপরটি রবীন্দ্রসঙ্গীতটি ‘তুমি মোর পাও নাই পরিচয়’ টেস্ট কপি রূপে রয়ে
গেছে যা আমার নিজস্ব সংগ্রহে আজোও সংরক্ষিত।
![]() |
অখিলবন্ধু ঘোষের গাওয়া অপ্রকাশিত রবীন্দ্রসংগীত |
সারাটি জীবন সঙ্গীতরসিক বাঙালীকে তাঁর হৃদয় থেকে উৎসারিত গানে মাতিয়ে দিয়ে ১৯৮৮ সালের ২০শে মার্চ অখিলবন্ধু স্বর্গলাভ করেন। অনেক শিল্পীর মাঝে বাংলা গানের পুরোপুরি বদলে যাওয়া এই পৃথিবীতে তিনি যেন আজ অনেকটাই ব্রাত্য । কি চেয়েছিলেন আর কি পেলেন তিনি , তা খুঁজতে গিয়ে যেন মেলে তাঁর গানের মতো হাহাকার আর একরাশ বেদনামথিত দীর্ঘশ্বাস !
অসামান্য লেখা কানাই দা, keep it up....
ReplyDeleteধন্যবাদ ভাই 😍
Delete