চোখে ঘোর ঘুম । ঢুলে আসছে দুচোখ। তবু আসর ছেড়ে উঠবে না কিছুতেই। লখিন্দরের মৃত্যুতে দুখিনী বেহুলা গাইছে “কেমনে
সহিব এ কাল যাতনা –“তারপর কত না বিলাপ পতিহারা সতীর। সেই দুঃখের নিশি শেষ হবে সেই বার্তা নিয়ে এলো চারণ। গেরুয়া আলখেল্লা , মাথায়
পাগড়ী, দুহাত ছড়িয়ে গাইছে “ মহাসতী
ওগো কেঁদোনা জননী—এতেই যেন ঘুম ছেড়ে যায় ছোট্ট ছেলেটির।বহুরু গাঁয়ের মাটির পথে ছূটছুটি
খেলা । তার ফাঁকে
মনে পড়ে যায় সেই যাত্রা গানের সুর। খিড়কির
পুকুর পাড়ে বসে কখন আনমনে ছুঁড়ে দেয় ঢিলটা। গোল গোল থালার মতো তরঙ্গ দুলে ওঠে। আবার মিলিয়ে যায়। সেদিকে চেয়ে থাকে আর মনের অজান্তে গুনগুন সু্রে গেয়ে ওঠে
“ মহাসতী ওগো ---কেঁদোনা
 |
যৌবনে হেমন্ত মুখোপাধ্যায় |
বাবা কালিদাস মুখোপাধ্যায় কাজ করতেন ম্যাকিনন্ & ম্যাকেঞ্জীতে। হাঁটা পথে স্টেশনে এসে ট্রেন ধরে কলকাতায় আসতে হতো নিত্যদিন। তাই একসময় গাঁয়ের
বাস ছেড়ে ভবানীপুরের রূপনারায়ণ নন্দন লেনে
বাসা করলেন। ছেলেকে ভর্তি করালেন মিত্র ইস্টিটিউশনে
। সেখানেই সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সাথে আলাপ আর বন্ধুত্ব। সেই বয়সেই লিখতে শুরু করেছিলেন সুভাষ। স্কুলে গিয়ে টিফিনের ফাঁকে গানবাজনা আর কবিতায় মেতে থাকতেন দুই বন্ধু । তখন হেমন্তর বয়স চোদ্দ। একদিন দুই বন্ধু গেলেন গারস্টিন প্লেসের রেডিও স্টেশনে । নির্বাচিত হলেন । কমল দাশগুপ্তর সুরে সেদিন একটি গান গাইলেন ‘আমার গানেতে এলে , নবরূপে চিরন্তনী/বাণীময় নিলীমায় শুনি তব চরণধ্বনি’ , কথা বসিয়েছিলেন বন্ধু সুভাষ । অপর গানটি ছিল ভাটিয়ালী ‘ আকাশের আরশিতে ভাই।
 |
বন্ধু সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের সঙ্গে |
কিন্তু গান বাজনায় কি হবে ! কালিদাস মুখার্জির ইচ্ছে ছেলে বড় হয়ে প্রতিষ্ঠিত হোক, চাকরি করুক । তাই প্রবেশিকা পরিক্ষায় বসালেন ছেলেকে । পরীক্ষায় উত্তীর্ন ও হলেন।ভর্তি করালেন যাদবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজে। কিন্তু কিছুদিন পর তাঁর মনে হোল মনটা যেন ঠিক পথে আর চলছেনা। বন্ধুবান্ধবদের কেউ খেলে, কেউ কবিতা লেখে। তাঁর মন যেন শুধু
পড়ে থাকে গানের দিকে। এইসব কঠিন কঠিন পড়াশোনায় আর তাঁর মন লাগেনা। তাই বাড়ির কাজ আর পড়াশোনার মধ্যে সময় হলেই কলেজের বন্ধুদের সাথে গান নিয়েই মেতে
থাকতেন হেমন্ত । অথচ তখনোও পর্যন্ত প্রথাগত গানের শিক্ষা বলে
কিছুই ছিলনা তাঁর । প্রতি বছর স্কুলের ছুটিতে বেনারসে
বেড়াতে গিয়ে মাসতু্তো দিদি লীলার কাছে হারমোনিয়াম নিয়ে বসা এই যা । কিন্তু মনটা সর্বক্ষন ছিল সুরে ভরপুর। আর কণ্ঠ ও ছিল সোনা গলানো ! বাবা
রেগেই যেতেন মাঝে মধ্যে, বলতেন “এতো করে ভর্তি করালাম কলেজে , পড়াশোনা তো হচ্ছে খুব-----“ কালিদাস
মুখার্জি দেখলেন তাঁর মেজছেলের মতিগতি ভালো নয়। সারাদিন পড়ে রয়েছে গান নিয়ে । অবশেষে বাবার আশঙ্কা সত্যি হয়।কলেজ যাওয়া পুরোপুরি বন্ধ হয় একসময় । সঙ্গী সুভাষ মুখোপাধ্যায় কবিতা , গান লেখেন আর তাতে সুর বসিয়ে গাইছে্ন হেমন্ত বন্ধুর বাড়ির আড্ডা থেকে পাড়ার জলসা। কিন্তু এদিকে কঠিন বাস্তব।সংসারে স্বাচ্ছন্দ নেই। কি হবে ! কালিদাস ও চিন্তায়।নিজের স্বল্প আয় আর ছেলের দু চারটে গানের টিউশনি, তাতে আসে মাসে
পনের কুড়ি টাকা।
 |
কবি- গীতিকার নরেশ্বর ভট্টাচার্য |
কিছুতো একটা উপায় করতে হবে।উপায় হল হঠাৎই। পিতৃবন্ধু শান্তি বোস চেলো বাজাতেন কলম্বিয়া কোম্পানিতে। তিনিই নিয়ে গেলেন বাংলার তখন বিখ্যাত সুরকার শৈলেশ দত্তগুপ্তর
কাছে। তিনি তখন ছিলেন কলম্বিয়া কোম্পানীর রেকর্ডিং রুমের দায়িত্বে।সঙ্গীতজ্ঞ শৈলেশ দত্তগুপ্ত ছিলেন
সঙ্গীতাচার্য ভীষ্মদেব চট্টোপাধায়ের প্রথম গুরু নগেন্দ্রনাথ দত্তের শিষ্য। কলম্বিয়া রেকর্ডের দায়িত্বে
থাকাকালীন বহু নবীন প্রতিভাবান শিল্পীকে গান রেকর্ড করার সুযোগ করে দিয়েছিলেন এবং
পরবর্তীকালে সেইসব শিল্পীদের সঙ্গীত জগতে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার আড়ালে এই মানুষটির অবদান উল্ললেখযোগ্য ও স্মরণীয় ।
 |
হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের প্রথম রেকর্ড |
 |
সুরকার শৈলেশ দত্তগুপ্ত |
সেদিন হেমন্তর গান শুনে তাঁর গান রেকর্ড করাতে আগ্রহী হয়েছিলেন শৈলেশ
দত্তগুপ্ত। কবি নরেশ্বর ভট্টাচার্যর কথায় আর
শৈলেশ দত্তগুপ্তর সুরে ১৯৩৭ সালের ডিসেম্বর মাসে প্রকাশিত হয় হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের
প্রথম রেকর্ড 'জানিতে যদিগো তুমি ---আর 'বলো গো বলো মোরে -(GE 2464)।
আর কলম্বিয়া রেকর্ড তাদের প্রচার পুস্তিকায় লিখেছিল-
'মানুষের রসলোলুপ চিত্ত আবহমানকাল ধরিয়া নিত্যনতুন
রসচক্রের সন্ধানে ফিরিতেছে। অমৃত মন্থনের অমৃত লাভ করিয়া একাকী ভোগ করিয়া তৃপ্ত হয়
না।তাই আমরা এই নবাগত শিল্পীর গীতসুধা সকলকেই উপহার দিলাম। রসবান শিল্পীর আধুনিক
দুইখানি গান রসশ্রীমণ্ডিত।'
 |
১৯৩৭ সালে প্রকাশিত কলম্বিয়া রেকর্ডের ক্যাটালগ |
আর ১৯৩৯ সালের কলম্বিয়া গীতিমালিকায় লেখা হয়েছিল 'সমুদ্রমন্থনে কেহ পাইলো সুধা, কেহ পাইলো
গরল।সুর সমুদ্রমন্থনে এই নবীন শিল্পী অমৃত ধারার অধিকারী হইয়াছেন।এ অমৃত নিরালায়
একাকী উপভোগ করিলে অতৃপ্তির সম্ভাবনাই বেশি।তাই তিনি তাহার গন্ধদানীস্বরূপ কণ্ঠ
হইতে শিশির বর্ষনের ন্যায় ইহা বিতরন করিতেছেন। সুর আছে ভাব নাই যে গানে তাহা
নিষ্ক্রিয় ওষধির তুল্য । কিন্তু সুরে ভাবে বিদ্রাবিত যে গান তাহার ক্রিয়া জীবনের
আনন্দ উৎসে বিকাশে। এই শিল্পীর গানে এই দুটি
বীজগুন প্রত্যক্ষভাবে সুপরিষ্ফুট।
তাহার গান শুনিতে শুনিতে মনে হয় আলোকের পবিত্র ঝরণা ধারায় স্নান করিতেছি’।
এ হল তাঁর জীবনের
প্রথম রেকর্ডের কাহিনী। হেমন্ত মুখোপাধ্যায়ের বাংলা সিনেমার
জন্য প্রথম নেপথ্য কণ্ঠদান করেন ১৯৪১ সালের ‘নিমাই সন্ন্যাস’ ছবিতে। কলম্বিয়া রেকর্ড থেকে তার সেই
রেকর্ড প্রকাশিত হয়। 'নিমাই সন্ন্যাস' ছায়াছবির জন্য অজয় ভট্টাচার্যর কথায় এবং হরিপ্রসন্ন দাশের(এইচ.পি. দাশ) সুরে তিনি গাইলেন
“ প্রভু, দেখা দাও প্রভু দেখা দাও/হৃদয়ে তুমি যদি অসীম আলো.. , এবং কাঁহা কানু কহি
হিয়া ঝরু তহি /পথ চলি আঁধারিল আঁখিয়া(GE
2559) , এই ছবির সহকারী সঙ্গীত পরিচালক ছিলেন
পবিত্র চট্টোপাধ্যায়।

এখানে একটা কথা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঐ বছরেই মুক্তি পায়
‘রাজকুমারের নির্বাসন’ । সঙ্গীত পরিচালক শচীনদেব বর্মণ। অজয় ভট্টাচার্যের কথায়
সিনেমার সাউণ্ড ট্র্যাকে বেচু দত্ত গাইলেন 'জাগো প্রথম প্রনয় লাজ লয়ে.. এবং ‘বন্ধু
হে তুমি এলে। রিমেক কিংবা ভার্সন গানের প্রচলন আজকে নয় ।বহুকাল আগে তার সুচনা। **হিন্দিতে ভার্সন গানের চল সেই ১৯৩২ সালে থেকে । 'ইন্দ্রসভা' ফিল্মে সাউণ্ডট্র্যাকে গেয়েছিলেন মিস্ ভায়োলেট, আর সেই একই গান রেকর্ডের জন্য পরিবেশন করেছিলেন জাহানারা কজ্জন । বহু প্রখ্যাত শিল্পীরা বহু গানের রিমেক করেছেন বা সিনেমার গান পরবর্তীকালে
গ্রামোফোন রেকর্ডের জন্য গেয়েছেন। কি বাংলায় কি হিন্দিতে।
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় তেমনি রেকর্ডের প্রয়োজনে ‘রাজকুমার নির্বাসন’ সিনেমায়
বেচু দত্তর গাওয়া গান দুটি গাইলেন কলম্বিয়া রেকর্ড থেকে ১৯৪০ সালেই। রেকর্ড নম্বর (GE 2558) অনুসারে এটি নিমাই সন্ন্যাস ছবির আগেই প্রকাশিত। তা নাহলে এই গান যদি তিনি সিনেমার জন্য গাইতেন ‘রাজকুমারের নির্বাসন’ সিনেমায় হয়ে যেত
তাঁর প্রথম প্লেব্যাক ! কিন্তু এই গান দুটি ভার্সন গান হিসাবেই রয়ে গেছে।
 |
সুরকার হরিপ্রসন্ন দাশের সঙ্গে |
হেমন্ত
মুখোপাধ্যায়ের প্রথম একক কণ্ঠে শুধুমাত্র রেকর্ডের জন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত প্রকাশিত
হয় ১৯৪৪ সালের জুন মাসে কলম্বিয়া থেকে, ‘(আমার) আর হবেনা দেরি.. এবং ‘কেন পান্থ এ
চঞ্চলতা ..(GE 2642) কিন্তু শিল্পী প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীতের প্লেব্যাক করেন ১৯৪২ সালে ‘অপরাধ’ সিনেমায় সুপ্রভা সরকারের সহশিল্পী হিসাবে ।
 |
গ্রামোফোন রেকর্ডে প্রকাশিত প্রথম রবীন্দ্রসঙ্গীত(Non-Film) |
এই ছবিতে
‘ঐ যে ঝড়ের মেঘে.. (H 1013) গানটিতে হেমন্ত মুখার্জীর কণ্ঠ পাওয়া যায়। ছবির সঙ্গীত
পরিচালক ছিলেন হরিপ্রসন্ন দাশ।তারপর ১৯৪৩ সালে প্রিয়বান্ধবী সিনেমার জন্য তিনি একক কণ্ঠে রবীন্দ্রসঙ্গীত
গান যা নিউ থিয়েটার্স হিন্দুস্থান রেকর্ড লেভেলে প্রকাশিত হয়। প্রনব দের সঙ্গীত পরিচালনায় গানটি ছিল “ পথের শেষ কোথায়, কি আছে শেষে ( H 1032 G, এপ্রিল মাসে প্রকাশিত)।
 |
সুরারোপিত ছবি (Released First) |
১৯৪৭সালের ২০শে জুন
মুক্তিপ্রাপ্ত অর্ধেন্দু মুখোপাধ্যায়
পরিচালিত ‘পূর্বরাগ ‘ ছায়াছবিতে প্রথম এককভাবে সঙ্গীত রচনার ও পরিচালনার দায়িত্ব পান।
কলম্বিয়া এবং হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে সেই গানের প্রকাশ পায়। কলম্বিয়া
রেকর্ড থেকে তিনি নিজে গেয়েছেন “এই দখিন
হাওয়া ( সহশিল্পী বেলা মুখোপাধায়) এবং ‘এই আঁধারে নাই পথ [GE 7075] আর হিন্দুস্থান রেকর্ড
থেকে বেরিয়েছিল সবিতা সেনের কণ্ঠে ‘আজি মোর ফুলদল ফোটে নাই , তবু পথিক আসিবে জানি (H 1243 G)। গানের কথা লিখেছিলেন গৌরীপ্রসন্ন মজুমদার যা গীতিকারের জীবনে সিনেমার জন্য প্রথম গান লেখা।
 |
হিন্দুস্থান রেকর্ড থেকে প্রকাশিত পূর্বরাগ সিনেমার রেকর্ড |
ঐ বছরেই হেমেন গুপ্ত পরিচালিত ‘অভিযাত্রী’ ছবিতেও এককভাবে সঙ্গীতপরিচালকের দায়িত্ব
পান । এখানে উল্লেক্ষ্য ‘অভিযাত্রী ‘ ছায়াছবি পূর্বরাগের
আগেই ৭ই ফেব্রুয়ারী মুক্তি পায় । এই
সিনেমায় ‘বজ্রমানিক দিয়ে গাঁথা( বিনতা রায়)/ব্যর্থ প্রাণের আবর্জনা ( হেমন্ত
মুখোপাধ্যায় ও বিনতা রায়)[GE 7065], খরবায়ু বয় বেগে/ভাঙো বাঁধ ভেঙে দাও..(সমবেত)[GE 7066] প্রভৃতি রবীন্দ্রসঙ্গীতের সঙ্গীত পরিচালনার দায়িত্বে
ছিলেন তিনি ।
তাঁর প্রথম
হিন্দি গীত প্রকাশিত হয় ১৯৪৩ সালের সেপ্টেম্বর মাসে কমল দাশগুপ্তর সুরে এবং ফৈয়জ হাসমীর কথায় “ কিত্
নে দুখ্ ভুলায়া তুম্নে .. এবং ‘ ও প্রীত্ নিভানেবালী( GE 2603)। অতুলপ্রসাদের গানের প্রথম রেকর্ড করেন ১৯৫৯ সালের 'ক্ষনিকের
অতিথি' ছবিতে। রেকর্ডের একপিঠে ছিলো ঐ সিনেমার জন্য ‘ কে তুমি বসি নদীকুলে..আর উল্টোপিঠে ছিলো রেকর্ডের জন্য গাওয়া ‘জল বলে চল ...(GE 30448)
হেমন্ত মুখোপাধ্যায় একটা যুগের নাম থেকে তিনি যুগোত্তীর্ণ।
তাঁর প্রতিটা গান নিটোল গোলাপের মতো।সঙ্গীতরসিক
বাঙালী সেই গন্ধে মাতোয়ারা সারাক্ষন। তাঁর প্রথম রেকর্ড জীবনের মধুর ছন্দে গন্ধে ভরা সেইসব গানের একটু পরশ পাওয়ার জন্য সামান্য এই অবতারনা।
কৃতজ্ঞতা - অমল বন্দ্যোপাধ্যায়
**তথ্য সুত্রঃ সঞ্জয় সেনগুপ্ত
আমার ভগবান...
ReplyDeleteKi osamanya lekha ...👍👍
ReplyDeleteধন্যবাদ
ReplyDeleteখুব ভালো লাগলো,এই তথ্যবহুল নিবন্ধটি।সত্যিই প্রিয়তম শিল্পী,হেমন্তের প্রত্যেকটি গান ই নিটোল,সুগন্ধী গোলাপের মতো।
ReplyDeleteঅনেক তথ্যে সমৃদ্ধ হলাম।
ReplyDelete